শিক্ষা

শিক্ষা কি তা নিয়ে নানা মনীষীর নানা মত। শিক্ষা বলতে আমরা সাধারণত বুঝি অজানা বিষয়কে জেনে নেওয়া। প্রাগৈতিহাসিক কালে বায়োজৈষ্ঠদের দ্বারা তরুন, যুবকদের সমাজের জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞান ও দক্ষতার প্রশিক্ষণ দেয়ার মাধ্যমে শিক্ষার শুরু হয়। সেই সময় মূলত মৌখিকভাবে এবং অনুকরণের মাধ্যমে শিক্ষা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ছবি আঁকা, গল্প বলা বা বর্ননার মাধ্যমে জ্ঞান, মূল্যবোধ এবং দক্ষতা এক প্রজন্ম থেকে পরের প্রজন্মে স্থানান্তরিত হয়েছে। সেটা ছিল অনানুষ্ঠানিক শিক্ষার যুগ। কালের বিবর্তনে শিক্ষা প্রক্রিয়ায় নানামূখী পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। আধুনিক কালে শিক্ষা ব্যাপকাংশে আনুষ্ঠানিক।

 শিক্ষা হল একটি উদ্দেশ্যমূলক ক্রিয়াকলাপ যা নির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনের জন্য পরিচালিত হয়। শিক্ষার মাধ্যমে ব্যাক্তির গুণাবলির পূর্ণ বিকাশের জন্য উৎসাহ দেওয়া হয় এবং সমাজে একজন উৎপাদনশীল সদস্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিা লাভের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জনে সহায়তা করা হয়। শিক্ষার মাধ্যমে মানুষের আচরণের কাঙ্ক্ষিত, বাঞ্চিত এবং ইতিবাচক পরির্বতন সাধিত হয়। শিক্ষা হলো ব্যক্তির সম্ভাবনার পরিপূর্ণ বিকাশ সাধনের অব্যাহত অনুশীলন।

শিক্ষা বাংলা ভাষার একটি শব্দ। যার উৎপত্তি হয়েছে সংস্কৃত ‘শাস  ধাতু থেকে। শাস এর অর্থ হলো নিয়ন্ত্রণ করা, শাসন করা, নির্দেশ দান করা ইত্যাদি। শিক্ষা শব্দের পাশাপাশি বা প্রতিশব্দ হিসেবে আমরা আর একটি শব্দ ব্যবহার করি সেটা হলো ”বিদ্যা”। এই বিদ্যা শব্দের উৎপত্তি হয়েছে সংস্কৃতি “বিদ্” থেকে যার অর্থ জানা। তাহলে বলা যায় জানার উদ্দেশ্যে কোনো কিছু সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করাই শিক্ষা।

আবার আমরা শিক্ষার ইংরেজি প্রতিশব্দ – Education ব্যবহার করি। এই – Education শব্দটি এসেছে ল্যাটিন শব্দ  Educere থেকে যার ইংরেজি অর্থ হচ্ছে To lead out অর্থাৎ শিশু এবং শিক্ষার্থীর ভিতরের সম্ভাবনাকে বাইরে বের করে নিয়ে আসা বা বিকশিত করা।

কারো কারো মতে Education শব্দটির মূল ল্যাটিন শব্দ Educare যার অর্থ হল To bring up – অর্থাৎ প্রতিপালন করা বা পরিচর্যা কর । এই অর্থে শিক্ষা হচ্ছে , কতগুলি নির্দিষ্ট লক্ষ্য ও আদর্শ সামনে রেখে শিশুকে সঠিকভাবে লালন-পালন করার প্রক্রিয়া।

ভিন্ন আরেকটি  মত অনুযায়ী – Education  শব্দটি ল্যাটিন শব্দ Educatum থেকে এসেছে, যার অর্থ হল- The act of training । অর্থাৎ শিক্ষার অর্থ হচ্ছে শিশু বা শিক্ষার্থীকে ভবিষ্যৎ জীবন উপযোগী কৌশল আয়ত্ত করার প্রশিক্ষণ দেওয়া ।

অন্য আরেকটি মতে Education শব্দটি এসেছে ল্যাটিন Edex এবং Duccrduc শব্দগুলো থেকে। যার শাব্দিক অর্থ হল যথাক্রমে বের করা ,পথ প্রদর্শন করা । অর্থাৎ সুপ্ত প্রতিভা বিকশিত করা এবং সামনে এগিয়ে যাওয়ার পথ সুগম করে দেওয়া।

শিক্ষা সম্পর্কে বিশিষ্ট মনীষীদের মতামত আমরা দেখে নেই -

এরিস্টটল – সুস্থ দেহে সুস্থ মন তৈরি করাই হলো শিক্ষা।

সক্রেটিস – শিক্ষা হলো মিথ্যার অপনোদন এবং সত্যের বিকাশ।

মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র বলেন, শিক্ষা কোনো ব্যক্তিকে পরিবর্তন করে পরীক্ষানিরীক্ষা করে মিথ্যা থেকে সত্য, অবাস্তব থেকে বাস্তব, কল্পনা থেকে প্রকৃতকে আলাদা করতে সক্ষম করে তোলে।

এফ. জে. ব্রাউন শিক্ষা সম্পর্কে বলেন, “শিক্ষা এমন একটি প্রক্রিয়া যা কারো জন্ম থেকে শুরু হয়ে জীবনব্যাপী চলতে থাকে। শিক্ষাই জীবন, পুরোটা জীবনই শিক্ষা”।

জন ফ্রেডারিক হার্বার্ট বলেছেন, “মানুষের নৈতিক চরিত্রের বিকাশ সাধন হলো শিক্ষা”।

স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন, “শিক্ষা হলো মানুষের অন্তর্নিহিত মহত্বের বিকাশ”

কৌটিল্য – শিক্ষা হলো শিশুকে দেশ বা জাতিকে ভালোবাসার প্রশিক্ষণ দেওয়া কৌশল।

শঙ্করাচার্য – আত্মজ্ঞান লাভ করাকে শিক্ষা বলে।

শিক্ষার নানামূখী উদ্দেশ্য রয়েছে। যেমন, জ্ঞানার্জনমূলক লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য, বৃত্তিমূলক লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য, সামাজিক লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য, নৈতিক চরিত্র গঠমূলক ও লক্ষ্যে পৌঁছানোর উদ্দেশ্য, জীবনধারামূলক লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। শিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীর ব্যক্তিক লক্ষ্যে পৌঁছানোর মধ্য দিয়ে যে সব উদ্দেশ্য অর্জন করা সম্ভব সেগুলো হলঃ দৈহিক ও মানসিক বিকাশ সাধন। আত্মোপলব্ধি ও আত্মপ্রকাশের দক্ষতা বৃদ্ধি করা। আত্মিক বিকাশ সাধন। অন্তর্নিহিত ক্ষমতার বিকাশ ঘটানো। উচ্চতর আদর্শ জাগ্রত করা। নিজেকে জানার দক্ষতা বৃদ্ধি করা। আত্মবিশ্বাসী ও বুদ্ধিবৃত্তিক স্বাধীন স্বত্ত্বা হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলা।