753 Times Visited
A_Ahmed
ডিসেম্বর ২৩, ২০২২
নিঝুম দ্বীপের ইতিহাস
কি অদ্ভুত সম্মোহনী শব্দ "নিঝুম"। আর এই মোহ জাগানিয়া সম্মোহনী শব্দ দিয়েই দ্বীপের নামকরণ নিঝুম দ্বীপ। বঙ্গোপসাগর উপকুলে একটি ছোট্ট দ্বীপ নিঝুম দ্বীপ। নোয়াখালী জেলার দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ার অন্তর্গত এই দ্বীপটি। প্রায় ১৪,০৫০ একরের দ্বীপটি ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে সমুদ্র বক্ষে জেগে ওঠে। ১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে ওসমান বাথানিয়া (যিনি মহিষ রাখেন তাকে স্থানীয় ভাষায় বাথানিয়া বলা হয়) প্রথম বসতি স্থাপন করেন। তার নামে এই দ্বীপকে চর ওসমান ও বলা হত একসময়। এই দ্বীপটি অত্যন্ত বালুময় তাই একে বাল্লার চর বা বালুর চর নামে ও ডাকা হত। ১৯৭০ এর ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ে দ্বীপটিতে সকল প্রাণের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যায়। ঘূর্ণিঝড়ের পরে তৎকালীন হাতিয়ার জননন্দিত নেতা আমিরুল ইসলাম কালাম সাহেব দ্বীপটিতে পরিদর্শনে গিয়ে কোন প্রাণের অস্তিত্ব দেখতে না পেয়ে আক্ষেপের সুরে বলেছিলেন হায় নিঝুম! সেখান থেকেই দ্বীপটির নাম নিঝুম দ্বীপ হয়ে যায়। ২০০১ সালের ৮ এপ্রিল বাংলাদেশ সরকার পুরো দ্বীপটিকে জাতীয় উদ্যান হিসেবে ঘোষণা করে। ২০১৩ সালে দ্বীপটি জাহাজমারা ইউনিয়ন হতে পৃথক হয়ে স্বতন্ত্র ইউনিয়নের মর্যাদা লাভ করে।
বাংলাদেশের বনবিভাগ ৭০-এর দশকে বন বিভাগের কার্যক্রম শুরু করে। প্রথমে পরীক্ষামূলকভাবে চার জোড়া হরিণ ছাড়ে। নিঝুম দ্বীপ এখন হরিণের অভয়ারণ্য। ১৯৯৬ খ্রিষ্টাব্দের হরিণশুমারি অনুযায়ী হরিণের সংখ্যা ২২,০০০। নোনা পানিতে বেষ্টিত নিঝুম দ্বীপ কেওড়া গাছে পরিপূর্ণ। ম্যানগ্রোভ বনের মধ্যে সুন্দরবনের পরে নিঝুম দ্বীপকে বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন বলে অনেকে দাবি করেন।
আয়তন ও জনসংখ্যা
প্রায় ৯২ বর্গ কিমি আয়তনের নিঝুম দ্বীপে ৯টি গুচ্ছ গ্রাম রয়েছে। এই গুচ্ছ গ্রাম ছাড়াও বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ছোট ছোট ঘর। ১৯৯৬ সালের হিসাব অনুযায়ী নিঝুম দ্বীপ ৩৬৯৭০.৪৫৪ হেক্টর এলাকা জুড়ে অবস্থিত। এর উত্তর অংশে রয়েছে বন্দরটিলা। দ্বীপের ৭০ ভাগ মানুষ মৎস্যজীবী ও ৩০ ভাগ কৃষিজীবী। গভীর সমুদ্র ও নদীতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে নিঝুম দ্বীপের মৎসজীবিগণ । নিঝুমদ্বীপে খালগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল চৌধুরীর খাল, পটকাখালী খাল, সোয়ানখালী খাল, ডুবাই খাল, ধামসাখালী খাল, ভট্রোখালী খাল, কাউনিয়া খাল, এবং লেংটা খাল।
শিক্ষাব্যবস্থা
নিঝুম দ্বীপে রয়েছে ৩টি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং একটি উচ্চ-মাধ্যমিক বিদ্যালয়। প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্রে অবস্থিত। শিক্ষা দীক্ষায় এখনো অনগ্রসর এই দ্বীপ।
জীববৈচিত্র্য
নিঝুম দ্বীপের এক দিকে মেঘনা নদী আর তিন দিকে বঙ্গোপসাগর ঘিরে রেখেছে। দ্বীপের সবচেয়ে আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্য হলো মাইলের পর মাইল জুড়ে কেওড়া বন আর সেই বনের পাতার আড়ালে লুকিয়ে থাকা চিত্রা হরিণ। ৭০-এর দশকে বন বিভাগ প্রথমে পরীক্ষামূলকভাবে চার জোড়া হরিণ ছাড়ে। এখন চিত্রা হরিণ নিঝুম দ্বীপের প্রধান বন্যপ্রাণী। দ্বীপটি হরিণের অভয়ারণ্য। ১৯৯৬ খ্রিষ্টাব্দের হরিণশুমারি অনুযায়ী হরিণের সংখ্যা ২২,০০০। নিঝুম দ্বীপে একর প্রতি চিত্রল হরিণের ঘনত্ব সুন্দরবনের চেয়ে তিনগুণ বেশি। বাঘের মতো কোনো মাংসাশী প্রাণী না থাকায় দ্রুতগতিতে এদের বংশবৃদ্ধি হচ্ছে। অন্যান্য স্তন্যপায়ী প্রাণীর মধ্যে রয়েছে নখরবিহীন উদবিড়াল, মেছো বাঘ ইত্যাদি। বিভিন্ন প্রজাতির পাখির মধ্যে রয়েছে নিশি বক, দেশি কানিবক, গোবক, দেশি পানকৌড়ি, ধূসর বক, কাদাখোঁচা, বালিহাঁস, কালোহাঁস, কোড়া, তিলা লালপা, তিলা সবুজপা ইত্যাদি। এই উদ্যান দেশি গাঙচষার অন্যতম প্রধান বিচরণস্থল। সরীসৃপের মধ্যে রয়েছে দেশি গুই সাপ ও নানান জাতের সামুদ্রিক কচ্ছপ। সামুদ্রিক কচ্ছপের গুরুত্বপূর্ণ প্রজননস্থল এই নিঝুম দ্বীপ।
দর্শনীয় স্থান
Ø ম্যানগ্রোভ বন: নিঝুম দ্বীপ বনায়ন প্রকল্প। আছে কেওড়া গাছ, গেউয়া গাছ আর লতাগুল্ম।
Ø চোয়াখালী ফরেস্ট ও চোয়াখালী সমুদ্র সৈকত।
Ø নামার বাজার সমুদ্র সৈকত (প্রধান ভূমি ও সৈকত)।
Ø কমলার দ্বীপ: সেখানের কমলার খালে অনেক ইলিশ মাছ পাওয়া যায়। এছাড়াও আশে পাশের দ্বীপগুলো সুন্দর। পুরো দ্বীপটা হেঁটে হেঁটে ঘুরে আসা যায়, মন ভরে যাবে।
Ø চৌধুরী খাল ও কবিরার (কবির নামে এক জেলের নৌকা ডুবে যায়) চর।
Ø দমার চর: বঙ্গোপসাগরেল সম্প্রতি আরো একটি সমুদ্র সৈকত জেগে উঠেছে। সৈকতটি একেবারে নতুন। একে এখন ডাকা হচ্ছে 'কুমারী সমুদ্র সৈকত' বলে। নিঝুম দ্বীপের লোকজন এবং মাছ ধরতে যাওয়া লোকেরা এই সৈকতকে বলে ‘দেইল বা বালুর স্তুপ।
যাতায়াত ব্যবস্থা
নিঝুম দ্বীপ জলরাশি বেষ্টিত একটি দ্বীপ তাই এর যোগাযোগ ব্যবস্থা অনুন্নত। দ্বীপের অভ্যন্তরে রিকশাই মূল বাহন। দ্বীপ থেকে অন্য কোথাও যেতে হলে হাতিয়া হয়ে যেতে হয়। ঢাকা থেকে হাতিয়া লঞ্চ যাতায়ত করে। সাধারনত পর্যটকরা লঞ্চযোগে হাতিয়া হয়ে নিঝুম দ্বীএ যাতায়ত করেন। হাতিয়া থেকে ২/৩ ঘন্টায় ট্রলারযোগে নদীপথে বা সড়ক পথে টেম্পু, সিএঞ্জি যোগে নিঝুম দ্বীপে যাওয়া যায়। এছাড়া হাতিয়া হয়ে নদীপথে ট্রলারযোগে হাতিয়া থেকে নোয়াখালী হয়ে ও বাইরে যাতায়ত করা সম্ভব। এ অঞ্চলের যাতায়ত ব্যবস্থায় জোয়ার-ভাটা এক গুরুত্ত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। জোয়ার ভাটার উপর নির্ভর করেই নোউকা,ট্রলার, লঞ্চ ইত্যাদি যাতায়ত করে।
পর্যটন সুবিধা
নিঝুম দ্বীপে পর্যটকদের জন্য রয়েছে অনেকগুলো হোটেল, রিসোর্ট ও সরকারি অবকাশযাপ কেন্দ্র। দ্বীপে বিদ্যুৎ নেই তাই জেনারেটরের মাধ্যমে বিদ্যুতের ব্যবস্থা করা হয় হোটেল ও অবকাশ যাপন কেন্দ্রে। খাবারের জন্য স্থানীয় হোটেল রয়েছে যাতে নানারকম সুস্বাদু খাবার পাওয়া যায়। খাবারের মধ্যে অন্যতম হল প্রাকৃতিকভাবে আহরিত মাছ, মহিষের দই, খেজুরের গুড়, প্রাকৃতিকভাবে পালিত দেশি হাস, মুরগি কবুতরের মাংস ইত্যাদি।
নিঝুম দ্বীপ বঙ্গোপসাগরের কোলে অবস্থিত প্রকৃতির এক অপার লীলাভূমি। অপার সৌন্দর্যময় ম্যানগ্রোভ বন, সমুদ্র সৈকত, হরিণ, ও পাখপাখালি , দীপের অভ্যন্তরে বিভিন্ন খাল, উচু উচু মাটির ঢিবি দ্বীপটিকে দিয়েছে অনন্য সুন্দর বৈশিষ্ট্য। ভরা পূর্ণিমার রাতে সৈকতে অথবা খালে কিংবা রিসোর্টের ছাদে আভাবনীয় এক মোহময় স্বররগীয় দৃশ্যের অবতারনা হয়। বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পের বিকাশে নিঝুম দ্বীপ হতে পারে এক অনন্য স্থান।
তথ্যসূত্রঃ উইকিপিডিয়া