996 Times Visited
A_Ahmed
ডিসেম্বর ২০, ২০২২
নবায়নযোগ্য শক্তি কি?
প্রাকৃতিক উৎস থেকে প্রাপ্ত শক্তি যা ব্যবহারের তুলনায় অধিক হারে প্রাকৃতিকভাবে তৈরি হয় তাই নবায়নযোগ্য শক্তি। এই শক্তি ব্যবহারের ফলে কখনো নিঃশেষিত হয়না। যেমন সূর্যালোক, বায়ু, বৃষ্টি, জোয়ার, জল তরঙ্গ এবং ভূতাপ ইত্যাদি। নবায়নযোগ্য শক্তির উৎস প্রচুর এবং আমাদের চারপাশে রয়েছে। বর্তমান নবায়নযোগ্য শক্তি সাধারণত বায়োগ্যাস, জলবিদ্যুৎ, সৌরশক্তি এবং বায়ু থেকে আসে।
বাংলাদেশের বর্তমান বিদ্যুৎ পরিস্থিতি
বাংলাদেশে শক্তির প্রধান উৎস প্রাকৃতিক গ্যাস (২৪%) যা আগামী কয়েক বছরের মধ্যে শেষ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে । বিদ্যুতের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে কয়লা, গ্যাস, ডিজেল ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করা হচ্ছে যা যথেষ্ট নয়। অধুনা দেশে পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করা হচ্ছে যা অত্যন্ত ব্য্যবহুল এবং এর রক্ষণাবেক্ষন অত্যন্ত কঠিন এবং ঝুকিপূর্ণ।
বর্তমানে দেশে সব মিলিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা ২৫ হাজার মেগাওয়াটের বেশি। এর মধ্যে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে উৎপাদন হচ্ছে মাত্র ৯০৯.১৯ মেগাওয়াট (টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী), যা সর্বমোট সক্ষমতার প্রায় ৪ শতাংশেরও কম। এর মধ্যে শুধু সৌরশক্তি থেকেই উৎপাদন হচ্ছে ৬৭৫.২ মেগাওয়াট, যা মোট নবায়নযোগ্য শক্তির ৭৪ শতাংশ। এ ছাড়া হাইড্রো থেকে ২৩০ মেগাওয়াট, বায়ু থেকে আসছে ২.৯ মেগাওয়াট, বায়োগ্যাস থেকে আসছে দশমিক ৬৯ মেগাওয়াট ও বায়োম্যাস থেকে আসছে দশমিক ৪ মেগাওয়াট।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলা এবং একই সঙ্গে ক্রমবর্ধমান বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে গুরুত্ব দিচ্ছে বিশ্বের উন্নত দেশগুলো। এরই মধ্যে অনেক দেশ ব্যবহৃত জ্বালানির ৩০ শতাংশ পর্যন্ত নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে জোগান দিচ্ছে। বাংলাদেশে গত এক যুগে বিদ্যুৎ খাতে অভাবনীয় সাফল্য এলেও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎস থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন একেবারেই সামান্য।
বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য শক্তির প্রধান উৎস গুলো নিম্নরূপ
সৌরশক্তি
বিশ্বের সবচেয়ে পরিবেশবান্ধব বিদ্যুৎ-এর একটি হচ্ছে সৌর বিদ্যুৎ, যেটি জলবায়ু পরিবর্তন রোধে একটি সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করে। প্রাকৃতিক কারণেই বাংলাদেশে সৌরবিদ্যুতের সম্ভাবনা উজ্জ্বল। কারণ এখানে বছরে তিনশ’ দিনেরও বেশি প্রতিদিন ৭ – ১০ ঘন্টা সূর্যালোক পাওয়া যায়। বাংলাদেশের বিভিন্ন সেক্টরে এই বিশাল পরিমান সৌরশক্তির একটি বড় সম্ভাবনা রয়েছে এবং এর ব্যবহার ঐতিহ্যগত জীবাশ্ম জ্বালানি-ভিত্তিক বিদ্যুতের ব্যবহার কমাতে ভূমিকা রাখবে, পাশাপাশি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সবুজ পরিবেশ নিশ্চিত করবে।
বায়ু শক্তি
বাংলাদেশে প্রায় ৭০০ কিলোমিটার উপকূল রেখা রয়েছে এবং বঙ্গোপসাগরে অনেক দ্বীপ রয়েছে। ভারত মহাসাগর থেকে আসা শক্তিশালী দক্ষিণ/দক্ষিণ-পশ্চিমী মৌসুমী বায়ুকে উইন্ডমিলের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে। বর্তমানে দেশে বেশ কিছু বায়ু সম্পদ মূল্যায়ন কার্যক্রম চলমান রয়েছে। তবে বাংলাদেশে বায়ু শক্তি খাতে অগ্রগতি চিত্তাকর্ষক নয়।
বায়োমাস
আধুনিক জৈববস্তু বা বায়োমাস ব্যবস্থার মধ্যে রয়েছে পরিত্যক্ত ফসল বা গাছ, কৃষি ও বনায়নের অবশিষ্টাংশ, কাঠ, কাঠকয়লা, শহুরে কঠিন বর্জ্য এবং বিভিন্ন জৈব বর্জ্য প্রবাহ যেমন গোবর এবং পোল্ট্রি লিটার ইত্যাদি যা শক্তির জনপ্রিয় উৎস।
বায়োমাস পোড়ানোর ফলে তৈরি শক্তি গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন করে, তবে কয়লা, তেল বা গ্যাসের মতো জীবাশ্ম জ্বালানী পোড়ানোর চেয়ে কম মাত্রায়। যাইহোক, জৈবশক্তি শুধুমাত্র সীমিত প্রয়োগে ব্যবহার করা উচিত, সম্ভাব্য নেতিবাচক পরিবেশগত প্রভাব এবং ফলস্বরূপ বন উজাড় এবং ভূমি-ব্যবহারের পরিবর্তনের কারণে।
জলবিদ্যুৎ
জলবিদ্যুৎ বর্তমানে বিদ্যুৎ খাতে নবায়নযোগ্য শক্তির সবচেয়ে বড় উৎস। এটি সাধারণত স্থিতিশীল বৃষ্টিপাতের পরিমাণের উপর নির্ভর করে এবং জলবায়ু-পরিবর্তন জনিত খরা বা বাস্তুতন্ত্রের পরিবর্তন দ্বারা নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত হতে পারে। হাইড্রোপাওয়ার উচ্চ থেকে নিম্ন উচ্চতায় জলের শক্তিকে ব্যবহার করে। এটি জলাধার এবং নদী থেকে উৎপন্ন হতে পারে। দেশের একমাত্র জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র (২৩০ মেগাওয়াট) কাপ্তাইতে অবস্থিত।
নবায়নযোগ্য শক্তি সেক্টরে অগ্রগতি
নবায়নযোগ্য শক্তি সেক্টরে বাংলাদেশের অগ্রগতি আশানুরুপ না হলেও গত কয়েক বছরে নবায়নযোগ্য শক্তি খাতে বেশ কিছুটা অগ্রগতি হয়েছে। সোলার হোম সিস্টেম (SHS) বাংলাদেশে একটি সফল উদ্যোগ। এটি গ্রামীণ এলাকায় বিশেষ করে অফ-গ্রিড অঞ্চলে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়েছে।
টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (স্রেডার) তথ্য অনুযায়ী, নবায়নযোগ্য শক্তি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য এ পর্যন্ত মোট ৪০টির ও অধিক প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। এসব প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে দেশের ২৫ জেলায় স্থাপিত সোলার পার্ক থেকে মোট দুই হাজার ১১০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া সম্ভব হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এর মধ্যে রাঙামাটির কাপ্তাই উপজেলায় ৭.৪ মেগাওয়াট, পঞ্চগড় সদর উপজেলায় ৮, কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলায় ২০ ও জামালপুরের সরিষাবাড়ী উপজেলার ৩ মেগাওয়াট সক্ষমতার চারটি সোলার পার্কের কাজ শেষ হয়েছে। এর বাইরে ময়মনসিংহে নির্মিত ৫০ মেগাওয়াট সোলার পার্কও এরই মধ্যে উৎপাদনে চলে এসেছে।
নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহারে বাংলাদেশের প্রতিকূলতা
বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য শক্তির সম্ভাবনা খুবই আশাব্যঞ্জক, বিশেষ করে সৌরশক্তির ক্ষেত্রে। কিন্তু অধিকাংশ জমি চাষাবাদে ব্যবহার হওয়ার কারনে কিছুটা প্রতিবন্ধকতা তৈরি হচ্ছে সোলার প্লান্ট স্থাপনে। কিন্ত ফ্লোটিং সোলার প্লান্ট স্থাপনের মাধ্যমে সহজেই আমরা এই সমস্যার উত্তরণ ঘটাতে পারি। এছাড়া ও রয়েছে দক্ষ জনশক্তি ও জনগনের সচেতনতার অভাব। বিশ্বের অন্যান্য দেশ আমদের বহু আগে থেকেই নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার নিয়ে কাজ করছে যেখানে আমরা শুরু করেছি ১০-১২ বছর আগে।
পরিশেষে
জীবাশ্ম জ্বালানী - কয়লা, তেল এবং গ্যাস অ-নবায়নযোগ্য সম্পদ যা তৈরি হতে কয়েক মিলিয়ন বছর সময় লাগে। শক্তি উৎপাদনের জন্য পোড়ানো হলেও, জীবাশ্ম জ্বালানী কার্বন ডাই অক্সাইডের মতো ক্ষতিকারক গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন ঘটায় যা আমদের পরিবেশ ধবংশের জন্য অনেকাংশে দায়ী। নবায়নযোগ্য শক্তি উৎপন্ন করা জীবাশ্ম জ্বালানী পোড়ানোর চেয়ে অনেক কম ক্ষতিকারক নির্গমন ঘটায় বা একেবারেই নির্গমন ঘটায় না। জীবাশ্ম জ্বালানি যা বর্তমানে ক্ষতিকারক নির্গমনের সিংহভাগের জন্য দায়ী, তা থেকে নবায়নযোগ্য শক্তিতে রুপান্তর জলবায়ু সংকট মোকাবেলার মূল চাবিকাঠি। নবায়নযোগ্য শক্তি এখন বেশিরভাগ দেশে সস্তা এবং জীবাশ্ম জ্বালানির তুলনায় তিনগুণ বেশি কর্মসংস্থান তৈরি করে।
তথ্যসূত্রঃ ইউএন ওয়েবসাইট ও দৈনিক কালের কন্ঠ।